Spread the love

এই লেখাটিতে নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর জীবনী গল্পের মত তুলে ধরা হয়েছে। সাথে রয়েছে নেতাজীর সঙ্গে যুক্ত অজানা সব গল্প। নেতাজীর জীবনীটি অন্যভাবে তুলে ধরার প্রচেষ্টা আশা করি পছন্দ হবে।

নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর জীবনী ও অজানা গল্পে যা যা থাকছে-

এক-ঝলকে নেতাজী-

বিষয় তথ্য
জন্ম ২৩ জানুয়ারি ১৮৯৭। কটক, উড়িষ্যা
মৃত্যু ১৮ আগস্ট ১৯৪৫ (বিমান দুর্ঘটনা- প্রমানিত নয়)
পরিচিত নাম দেশনায়ক, নেতাজী
পিতার নাম জানকীনাথ বসু
মাতার নামপ্রভাবতী দেবী
স্ত্রী এমিলি শেঙ্কল
সন্তান অনিতা বোস পাফ
শিক্ষা প্রেসিডেন্সি কলেজ, , স্কটিশ চার্চ কলেজ, ফিটজউইলিয়াম কলেজ (ক্যামব্রিজ), ICS উত্তীর্ণ
বিখ্যাত উক্তি “দিল্লী চলো”, “তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব”

সুভাষচন্দ্র বসু: এক বহ্নিশিখার অভিসার

ভূমিকা: এক নক্ষত্রের জন্মকথা

ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের সুবিশাল প্রেক্ষাপটে এমন কিছু চরিত্র আবির্ভূত হয়েছিলেন, যাঁদের তেজস্বিতা, দূরদর্শিতা আর আত্মত্যাগ আজও আমাদের শিরায় শিরায় এক অব্যক্ত আলোড়ন তোলে। সেইসব অগ্নিপুরুষদের মধ্যে অন্যতম উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক হলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। শুধু একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নয়, একজন দার্শনিক, একজন রাষ্ট্রনায়ক এবং সর্বোপরি একজন স্বপ্নদ্রষ্টা হিসেবে তিনি আজও আমাদের চেতনায় ভাস্বর। তাঁর জীবন ছিল এক আশ্চর্য উপাখ্যান – সাহস, সঙ্কল্প আর স্বদেশের প্রতি গভীর ভালোবাসায় পরিপূর্ণ।

এই মানুষটির জীবনকে প্রচলিত ছকের মধ্যে বেঁধে ফেলা কঠিন, কারণ তিনি ছিলেন গতানুগতিকতার ঊর্ধ্বে এক ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ব। তাঁর চলার পথ ছিল সম্পূর্ণ নিজস্ব, কণ্টকাকীর্ণ জেনেও তিনি সেই পথেই হেঁটেছেন অবিচল চিত্তে।

আজকের এই লেখায় আমরা সুভাষচন্দ্র বসুর জীবনকে কোনও শুষ্ক ইতিহাসের পাতা থেকে তুলে আনব না, বরং চেষ্টা করব গল্পের ছলে সেই মানুষটিকে অনুভব করার, তাঁর স্বপ্নগুলোকে ছুঁয়ে দেখার। তাঁর জীবনের পরতে পরতে লুকিয়ে থাকা নানা ঘটনা, তাঁর রাজনৈতিক দর্শন, তাঁর আপোষহীন সংগ্রাম – সবকিছুকেই আমরা দেখব এক নতুন আলোয়। উদ্দেশ্য একটাই, এই মহান দেশনায়কের জীবনের আঁচে নিজেদেরকে আরেকবার উষ্ণ করে তোলা, তাঁর দেখানো পথে চলার নতুন প্রেরণা খুঁজে পাওয়া। কারণ সুভাষচন্দ্র বসু কোনও অতীত নন, তিনি এক চিরন্তন বর্তমান, এক অফুরন্ত অনুপ্রেরণার উৎস।

তাঁর জীবনগাথা শুধু স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস নয়, তা এক আপোষহীন ব্যক্তিত্বের নিরন্তর লড়াইয়ের কাহিনি, যা যুগে যুগে পথ দেখাবে লক্ষ্যভেদী পথিককে।

আসুন, আমরা ডুব দিই সেই অগ্নিযুগের ইতিহাসে, অনুভব করি সেই সময়ের উত্তাপ, আর খুঁজে বের করার চেষ্টা করি – কে ছিলেন এই সুভাষ? কী ছিল তাঁর স্বপ্নের ভারতবর্ষ? কেন আজও কোটি কোটি ভারতবাসীর হৃদয়ে তিনি এক কিংবদন্তি নায়ক? এই যাত্রাপথ হয়তো দীর্ঘ হবে, কিন্তু আশা করি তা আপনাদের মনোগ্রাহী করে তুলবে।

ছোট্ট সুভাষ: ব্যক্তিত্বের প্রথম উন্মোচন আমি কারোর অধীন নই

১৮৯৭ সালের ২৩শে জানুয়ারি, বাংলা ক্যালেন্ডারের পাতায় দিনটা ছিল মাঘ মাসের এক উজ্জ্বল সকাল। ওড়িশার কটক শহরের এক সম্ভ্রান্ত বাঙালি পরিবারে জন্মগ্রহণ করলেন জানকীনাথ বসু ও প্রভাবতী দেবীর নবম সন্তান, সুভাষচন্দ্র। বাবা জানকীনাথ ছিলেন কটকের অত্যন্ত সফল এবং জনপ্রিয় আইনজীবী, ইংরেজ সরকারের পাবলিক প্রসিকিউটর হওয়া সত্ত্বেও যাঁর হৃদয়ে ছিল দেশীয় সংস্কৃতির প্রতি গভীর অনুরাগ।

মা প্রভাবতী দেবী, উত্তর কলকাতার হাটখোলার বিখ্যাত দত্ত পরিবারের কন্যা, ছিলেন ধর্মপ্রাণা, তেজস্বিনী এবং দৃঢ়চেতা এক নারী। এইরকম এক পরিমণ্ডলে সুভাষের বেড়ে ওঠা, যেখানে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের চিন্তাধারার এক বিরল সমন্বয় ঘটেছিল।

ছোটবেলা থেকেই সুভাষ ছিলেন আর পাঁচটা সাধারণ শিশুর থেকে অনেকটাই আলাদা। একদিকে যেমন ছিলেন মেধাবী, অন্যদিকে তাঁর চরিত্রে ফুটে উঠত এক আশ্চর্য দৃঢ়তা ও আত্মসম্মানবোধ। শোনা যায়, মাত্র ছয় বছর বয়সে কটকের প্রোটেস্ট্যান্ট ইউরোপিয়ান স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর, ইংরেজ শিশুদের থেকে ভারতীয়দের প্রতি অবজ্ঞাসূচক আচরণ দেখে ছোট্ট সুভাষের মনে প্রথম বিদ্রোহের স্ফুলিঙ্গ জ্বলে ওঠে। তিনি কিছুতেই মেনে নিতে পারতেন না এই অহেতুক ভেদাভেদ। তাঁর সেই বয়সের একটি বিখ্যাত উক্তি ছিল – “আমি কারোর অধীন নই”। এই ছোট্ট কথাটির মধ্যেই লুকিয়ে ছিল তাঁর ভবিষ্যৎ জীবনের মূল সুর।

সুভাষের বাল্যকালে তাঁর উপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছিলেন তাঁর মা প্রভাবতী দেবী এবং স্কুলের প্রধান শিক্ষক বেণীমাধব দাস। মায়ের কাছ থেকে পেয়েছিলেন ধর্মীয় অনুশাসন ও চারিত্রিক দৃঢ়তার শিক্ষা, আর বেণীমাধব দাসের কাছ থেকে পেয়েছিলেন প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা ও নৈতিকতার পাঠ। বেণীমাধব দাসের সংস্পর্শেই সুভাষের মনে দেশপ্রেমের প্রথম বীজ অঙ্কুরিত হয়। এছাড়াও, স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা কিশোর সুভাষকে গভীরভাবে আলোড়িত করেছিল।

বিবেকানন্দের আদর্শ – “জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর” এবং তাঁর তেজোদীপ্ত আহ্বান সুভাষের মনে এক গভীর আধ্যাত্মিক ও দেশাত্মবোধক চেতনা জাগিয়ে তোলে। একটা সময় তিনি এতটাই প্রভাবিত হয়েছিলেন যে, গৃহত্যাগ করে সন্ন্যাসী হওয়ার কথাও ভেবেছিলেন। লোকচক্ষুর অন্তরালে প্রায়শই তিনি ধ্যানমগ্ন থাকতেন, খুঁজতেন জীবনের গভীরতর অর্থ।

নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর জীবনী
নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর জীবনী

একটি স্বল্পজ্ঞাত তথ্য:

ছোটবেলায় সুভাষচন্দ্র তাঁর কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে একটি দল তৈরি করেছিলেন, যার উদ্দেশ্য ছিল দরিদ্র ও আর্ত মানুষের সেবা করা। তাঁরা গ্রামে গ্রামে ঘুরে দুঃস্থদের সাহায্য করতেন, এমনকি কলেরা রোগীর সেবা করতেও পিছপা হতেন না। এই ঘটনা তাঁর সংবেদনশীল মনের পরিচয় দেয়।

পড়াশোনায় বরাবরই তিনি ছিলেন তুখোড়। কটকের র‍্যাভেনশ কলেজিয়েট স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন। তাঁর স্মৃতিশক্তি ছিল প্রখর, আর যেকোনো বিষয় বোঝার ক্ষমতা ছিল অসাধারণ। কিন্তু শুধু পুঁথিগত বিদ্যায় তিনি সন্তুষ্ট ছিলেন না। খেলাধুলা, বিতর্ক এবং অন্যান্য সহপাঠ্যক্রমিক কার্যাবলিতেও তাঁর সমান উৎসাহ ছিল। এই সময়েই তাঁর মধ্যে নেতৃত্বের গুণাবলি বিকশিত হতে শুরু করে।

তিনি সহপাঠীদের কাছে যেমন জনপ্রিয় ছিলেন, তেমনই শিক্ষকদের কাছেও ছিলেন অত্যন্ত স্নেহভাজন। তবে তাঁর চরিত্রের বিদ্রোহী সত্তাটিও মাঝে মাঝে প্রকাশ পেত। অন্যায় দেখলে তিনি কখনও চুপ করে থাকতেন না, প্রতিবাদ করতেন সাহসের সঙ্গে। এই প্রতিবাদী মনোভাবই পরবর্তীকালে তাঁকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে এক আপোষহীন সংগ্রামী হিসেবে গড়ে তুলেছিল।

জানকীনাথ বসু চেয়েছিলেন তাঁর ছেলেরা উচ্চশিক্ষিত হয়ে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হোক। কিন্তু তিনি সন্তানদের উপর নিজের ইচ্ছা কখনও চাপিয়ে দেননি। সুভাষের আধ্যাত্মিক প্রবণতা এবং দেশসেবার আকাঙ্ক্ষা দেখে তিনি চিন্তিত হলেও, বাধা দেননি। বরং, তিনি সুভাষকে সময় দিয়েছিলেন নিজের পথ খুঁজে নেওয়ার জন্য। পরিবারের এই উদার ও মুক্ত চিন্তার পরিবেশ সুভাষের ব্যক্তিত্ব গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। তাঁর বড়দাদা শরৎচন্দ্র বসুও ছিলেন তাঁর অন্যতম অনুপ্রেরণা ও সমর্থক। দুই ভাইয়ের মধ্যে সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত নিবিড়, যা আজীবন অটুট ছিল।

এভাবেই, কটকের মাটি ও আলো-বাতাসে, পারিবারিক স্নেহচ্ছায়ায় এবং যুগপুরুষদের আদর্শে ছোট্ট সুভাষের জীবন বিকশিত হচ্ছিল এক অসামান্য সম্ভাবনার দিকে। তাঁর চোখে ছিল উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন, আর হৃদয়ে ছিল দেশমাতৃকার মুক্তির অদম্য আকাঙ্ক্ষা। কে জানত, এই শান্ত, সৌম্যকান্তি, অথচ দৃঢ়প্রতিজ্ঞ কিশোরটিই একদিন হয়ে উঠবেন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম কিংবদন্তি – নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু!

সুভাষচন্দ্র বসুর শিক্ষাজীবন: মেধার দীপ্তি থেকে দেশপ্রেমের আগুন

সুভাষচন্দ্র বসুর জীবন যদি এক মহাকাব্য হয়, তবে তাঁর শিক্ষাজীবন সেই কাব্যের প্রথম অঙ্ক—যেখানে মেধা, চিন্তাশক্তি, আত্মপ্রশ্ন এবং আত্মত্যাগ একসঙ্গে মিলে গড়ে তোলে একজন বিপ্লবীর আত্মা।

তাঁর শিক্ষার পথ কখনো সরল ছিল না। তিনি পড়াশোনায় অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন, কিন্তু একইসঙ্গে ছিলেন আত্মবিশ্বাসী, বিদ্রোহী ও নীতির প্রতি অটল। তাঁর ছাত্রজীবন একাধিক বার বাঁক নিয়েছে—শুধু পরীক্ষার রেজাল্ট দিয়ে নয়, তাঁর চিন্তার দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েও।

প্রাথমিক শিক্ষা: শৈশবেই মেধার আভাস

সুভাষচন্দ্র বসুর শিক্ষার সূচনা হয়েছিল তাঁর নিজ শহর কটকের প্রোটেস্ট্যান্ট ইউরোপিয়ান স্কুল-এ। খুব অল্প বয়সেই তাঁর মধ্যে অসাধারণ স্মরণশক্তি এবং আত্মশৃঙ্খলা দেখা যায়। তিনি প্রায়ই শিক্ষককে প্রশ্ন করে বিপাকে ফেলতেন, আর শিক্ষকরা বুঝতে পারতেন—এই ছেলেটা সবার থেকে ‘আলাদা’।

এরপর ভর্তি হন কটকের রাভেন্সহা কলেজিয়েট স্কুল-এ, যা ছিল সেসময়ের অন্যতম সেরা স্কুল। এখানেই তাঁর ভিত গড়ে ওঠে। ক্লাসে তাঁর উপস্থিতি, লেখাপড়ায় মনোযোগ এবং ভাষা জ্ঞান শিক্ষকদের বিস্মিত করত।

তিনি শুধু পড়াশোনাতেই নয়, চরিত্র গঠনে, শৃঙ্খলাবোধে এবং নৈতিক শিক্ষায়ও সবার উপরে ছিলেন। তাঁর বন্ধুদের মধ্যে তিনি ছিলেন একজন ‘নেতা’ যিনি বন্ধুদের দুঃখে সর্বদা আগে দাঁড়াতেন।

স্কুলজীবনে ব্যক্তিত্ব গঠনের শুরু

এই সময়েই তিনি পরিচিত হন স্বামী বিবেকানন্দ ও রামকৃষ্ণ পরমহংস-এর লেখার সঙ্গে। এই দুটি চরিত্র তাঁর মনোজগতকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। তিনি বলতেন:

“আমার আত্মাকে গড়ে তুলেছে বিবেকানন্দের দর্শন। আমি ওনার লেখার প্রতিটি শব্দ হৃদয়ে ধারণ করেছি।”

ছাত্রাবস্থায় তিনি বহু ধর্মীয় ও দার্শনিক বই পড়তেন। তাঁর কিশোর বয়সেই আত্মসমালোচনার ক্ষমতা জন্মে যায়, যা একজন নেতার অন্যতম গুণ।

কটকের র‍্যাভেনশ কলেজিয়েট স্কুল থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করার পর ১৯১৩ সালে উচ্চশিক্ষার জন্য সুভাষচন্দ্র পাড়ি জমান তৎকালীন ভারতের বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রভূমি কলকাতায়। ভর্তি হন প্রেসিডেন্সি কলেজে, দর্শনশাস্ত্র নিয়ে। প্রেসিডেন্সির দিনগুলি সুভাষের জীবনে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। এখানে তিনি একদিকে যেমন গভীর মননের সঙ্গে পাশ্চাত্য দর্শন অধ্যয়ন করেন, তেমনই অন্যদিকে সমকালীন ভারতের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতি সম্পর্কেও সচেতন হয়ে ওঠেন। এই সময়েই তাঁর অন্তরের সুপ্ত দেশপ্রেম প্রবলভাবে জাগ্রত হতে শুরু করে।

প্রেসিডেন্সি কলেজের দিনগুলোতেই সুভাষের প্রতিবাদী চরিত্র প্রথমবারের মতো প্রকাশ্যে আসে, যা তৎকালীন ব্রিটিশ শাসক ও শিক্ষাব্যবস্থাকে প্রবল ঝাঁকুনি দিয়েছিল। ঘটনাটি ঘটেছিল ১৯১৬ সালে। কলেজের ইংরেজ অধ্যাপক সি. এফ. ওটেন প্রায়শই ক্লাসে ভারতীয় ছাত্র এবং ভারতীয় সংস্কৃতি সম্পর্কে অবমাননাকর মন্তব্য করতেন। সুভাষ ও তাঁর সহপাঠীরা এই ধরনের অপমানজনক আচরণ নীরবে সহ্য করতে পারছিলেন না। তাঁরা সম্মিলিতভাবে অধ্যক্ষের কাছে এর প্রতিকার দাবি করেন, কিন্তু কোনও ফল হয়নি।

ইংরেজ অধ্যাপক E.F. Oaten ভারতীয় ছাত্রদের “কালে কুকুর” বলে অপমান করেন। এই অপমান সহ্য করতে পারেননি সুভাষ। একদিন সেই অধ্যাপককে প্রকাশ্যেই চড় মারেন।

এর ফলস্বরূপ সুভাষচন্দ্র বসুকে কলেজ থেকে বহিষ্কার করা হয়। এই ঘটনা তাঁর শিক্ষাজীবনে সাময়িক ছেদ টানলেও, তাঁর চারিত্রিক দৃঢ়তা ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী মানসিকতাকে আরও শাণিত করে তোলে। তিনি প্রমাণ করেছিলেন যে, আত্মসম্মানের প্রশ্নে তিনি কোনও আপোষ করতে রাজি নন, তা যত বড় শক্তির বিরুদ্ধেই হোক না কেন। এই ঘটনা সারা বাংলায় সুভাষকে এক প্রতিবাদী যুবক হিসেবে পরিচিত করে তোলে।

একটি স্বল্পজ্ঞাত তথ্য:

প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার পর সুভাষচন্দ্র মানসিকভাবে বেশ কিছুদিন বিপর্যস্ত ছিলেন। এই সময়ে তিনি উত্তর ভারতে তীর্থভ্রমণে বেরিয়ে পড়েন এবং বিভিন্ন সাধু-সন্ন্যাসীর সংস্পর্শে আসেন। এই ভ্রমণ তাঁর আধ্যাত্মিক চেতনাকে আরও গভীর করে তোলে।

বহিষ্কারের পর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের সহযোগিতায় সুভাষচন্দ্র স্কটিশ চার্চ কলেজে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পান। এখান থেকেই তিনি ১৯১৮ সালে দর্শনশাস্ত্রে প্রথম শ্রেণিতে বি.এ. পাশ করেন।

এই সময়টা তাঁর আত্মিক এবং বৌদ্ধিক বিকাশের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। তিনি Kant, Schopenhauer, Hegel-এর দর্শন গভীরভাবে পড়তেন। একইসঙ্গে তিনি বেদ, উপনিষদ, গীতা—সবই পড়তেন আত্মবিশ্লেষণের জন্য।

তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা জানিয়েছেন, তিনি মাঝে মাঝেই নির্জনে বসে ধ্যান করতেন, এবং প্রশ্ন করতেন:

“আমি কে? আমার জন্ম কেন? কিসের জন্য আমি নিজেকে তৈরি করছি?”

এই ধরনের প্রশ্ন তাঁকে আত্মপ্রশ্নের দিকে নিয়ে যায়—যা ভবিষ্যতে তাঁকে আত্মত্যাগের পথে এগিয়ে নিয়ে যায়।

স্কটিশ চার্চ কলেজে পড়ার সময়েও তিনি পড়াশোনার পাশাপাশি বিভিন্ন সমাজসেবামূলক কাজ এবং যুবকদের সংগঠিত করার প্রচেষ্টায় লিপ্ত ছিলেন। এই সময়েই তিনি উপলব্ধি করেন যে, শুধুমাত্র ব্যক্তিগত আধ্যাত্মিক উন্নতি বা বিক্ষিপ্ত প্রতিবাদের মাধ্যমে দেশের মুক্তি সম্ভব নয়। প্রয়োজন এক বৃহত্তর, সুসংগঠিত রাজনৈতিক সংগ্রামের।

সুভাষচন্দ্রের চরিত্রে জ্ঞানপিপাসা এবং আধ্যাত্মিক অনুসন্ধিৎসা বরাবরই প্রবল ছিল। একদিকে যেমন তিনি প্লেটো, কান্ট, হেগেলের মতো পাশ্চাত্য দার্শনিকদের রচনাবলী গভীর অভিনিবেশ সহকারে পাঠ করতেন, তেমনই অন্যদিকে ভারতীয় বেদ, উপনিষদ ও গীতার মর্মবাণীও তাঁকে গভীরভাবে প্রভাবিত করত। তিনি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের শ্রেষ্ঠ চিন্তাধারার সমন্বয়ে নিজের জীবনদর্শন গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। তাঁর মনে এই প্রত্যয় দৃঢ় হয়েছিল যে, ভারতের মুক্তি শুধুমাত্র রাজনৈতিক স্বাধীনতা প্রাপ্তির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, ভারতের আত্মিক জাগরণও একান্ত অপরিহার্য।

কলেজ জীবনেই সুভাষচন্দ্র ‘ইউনিভার্সিটি অফিসার্স ট্রেনিং কোর’-এ (University Officers’ Training Corps) যোগদান করেন এবং সামরিক প্রশিক্ষণে অত্যন্ত কৃতিত্বের পরিচয় দেন। এই প্রশিক্ষণ তাঁর মধ্যে শৃঙ্খলাবোধ ও শারীরিক সক্ষমতার গুরুত্বকে প্রতিষ্ঠিত করে। পরবর্তীকালে আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠনের সময় এই সামরিক অভিজ্ঞতা তাঁর কাজে লেগেছিল।

সুভাষচন্দ্রের শিক্ষাজীবনের এই পর্যায়টি ছিল তাঁর ভবিষ্যৎ জীবনের প্রস্তুতিকাল। প্রেসিডেন্সি কলেজের ঘটনা তাঁকে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রামে অবতীর্ণ হওয়ার প্রথম স্বাদ দিয়েছিল। অন্যদিকে, দর্শনশাস্ত্রের গভীর অধ্যয়ন এবং আধ্যাত্মিক অনুসন্ধান তাঁর অন্তর্দৃষ্টিকে প্রসারিত করেছিল, যা তাঁকে একজন নিছক রাজনীতিবিদ থেকে এক দূরদর্শী রাষ্ট্রনায়কে রূপান্তরিত করতে সাহায্য করেছিল।

তাঁর হৃদয়ে তখন একটাই সুর বাজছিল – “ভারত আমার প্রথম ভালোবাসা, আর এই ভালোবাসার জন্য আমি সবকিছু ত্যাগ করতে প্রস্তুত।” এই মন্ত্র বুকে নিয়েই তিনি এগিয়ে চললেন তাঁর জীবনের পরবর্তী অধ্যায়ের দিকে, যে অধ্যায় তাঁকে দাঁড় করাবে এক ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তের মুখোমুখি।

বিলেতের দিনগুলি আইসিএস ত্যাগ: স্বদেশের ডাক চাকরি নয়, চাই মুক্তি

১৯১৯ সাল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ সবেমাত্র শেষ হয়েছে, কিন্তু তার রেশ তখনও বিশ্বজুড়ে। ভারতে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের মতো নৃশংস ঘটনা ব্রিটিশ শাসনের দমনমূলক চরিত্রকে নগ্নভাবে প্রকাশ করে দিয়েছে। এই উত্তাল সময়েই সুভাষচন্দ্রের জীবনে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়। পরিবারের, বিশেষত বাবা জানকীনাথ বসুর, প্রবল ইচ্ছাকে সম্মান জানিয়ে তিনি ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস (আইসিএস) পরীক্ষায় অবতীর্ণ হওয়ার জন্য ইংল্যান্ড পাড়ি জমান। সেই যুগে আইসিএস ছিল ভারতীয় যুবকদের জন্য সবচেয়ে লোভনীয় এবং সম্মানজনক পেশা। ব্রিটিশ সরকারের সর্বোচ্চ প্রশাসনিক পদে কাজ করার সুযোগ, ক্ষমতা, প্রতিপত্তি – সবকিছুই ছিল এই চাকরির অঙ্গ।

সুভাষচন্দ্র কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিৎজউইলিয়াম হলে মানসিক ও নৈতিক বিজ্ঞান (Mental and Moral Sciences Tripos) নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। বিলেতের মুক্ত পরিবেশে তাঁর জ্ঞানপিপাসু মন আরও বিকশিত হওয়ার সুযোগ পায়। সেখানকার লাইব্রেরিগুলো ছিল তাঁর প্রিয় বিচরণক্ষেত্র।

পাশ্চাত্য সাহিত্য, দর্শন, ইতিহাস, রাষ্ট্রবিজ্ঞান – সবকিছুই তিনি গভীর আগ্রহের সঙ্গে অধ্যয়ন করতে থাকেন। কিন্তু তাঁর অন্তরের গভীরে সবসময় জেগে থাকত পরাধীন ভারতবর্ষের ছবি। দেশের মানুষের দুঃখ-দুর্দশা, ব্রিটিশ শাসনের অন্যায়-অত্যাচার তাঁকে প্রতিনিয়ত পীড়িত করত।

নেতাজীর জীবনী
নেতাজীর জীবনী

আত্মবিশ্লেষণ গভীর অধ্যয়ন: সুভাষের ছাত্রজীবনের অতিরিক্ত দিক

সুভাষচন্দ্র ছাত্রজীবনে ছিলেন প্রচণ্ড আত্মবিশ্লেষণী। তিনি প্রতিদিন রুটিন তৈরি করে চলতেন। ইংল্যান্ডে থাকা অবস্থায় তাঁর প্রতিদিনের সময়সূচী এমন ছিল:

সময়কাজ
৫:০০ AMঘুম থেকে ওঠা ও ধ্যান
৫:৩০–৭:০০বই পড়া (দর্শন, ইতিহাস)
৭:০০–৮:০০শরীরচর্চা
৮:০০–৯:০০প্রাতরাশ ও সংবাদপত্র
৯:০০–১:০০লাইব্রেরি পড়াশোনা
দুপুরক্লাস ও নোট প্রস্তুত
সন্ধ্যাচিঠি লেখা, ধ্যান, সংগীত শুনা

তিনি একজন ‘সিস্টেম্যাটিক থিংকার’ ছিলেন। প্রতিটি কাজের জন্য টাইমটেবিল তৈরি করতেন, এমনকি চিঠি লেখার জন্যও নির্দিষ্ট সময় রাখতেন।

এই মানসিক টানাপোড়েনের মধ্যেই তিনি মাত্র আট মাসের প্রস্তুতিতে ১৯২০ সালে আইসিএস পরীক্ষায় অংশ নেন এবং অত্যন্ত কৃতিত্বের সঙ্গে চতুর্থ স্থান অধিকার করেন।

তাঁর রেজাল্ট এমনই ভালো হয়েছিল যে ব্রিটিশরাও প্রশংসা করে বলেছিল—“He’s one of the finest Indian candidates we have ever seen.”

এমন ঈর্ষণীয় সাফল্য লাভ করার পর যখন সকলেই তাঁর উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখছেন, ঠিক তখনই সুভাষচন্দ্র এক অভাবনীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। যে আইসিএস চাকরি লক্ষ লক্ষ ভারতীয় তরুণের কাছে ছিল স্বপ্নের শিখর, সেই চাকরি তিনি প্রত্যাখ্যান করার মনস্থির করেন।

মাত্র কয়েক মাস আগে, তিনি একদিন বাবাকে চিঠি লেখেন:

“আমার হৃদয় বলে আমি ভারতের স্বাধীনতার জন্য কাজ করি। আমি জানি, ব্রিটিশ সরকারের চাকরি করলে আমি আমার আত্মাকে বিক্রি করব।”

এই কথা শুনে পরিবার স্তম্ভিত হয়। বাবার দৃষ্টিতে এটি ছিল আত্মহত্যার শামিল। কিন্তু সুভাষ বলেন—

“একটি সোনার খাঁচা আমার মুক্তির পথ হতে পারে না। আমি স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করতে চাই।”

এই সিদ্ধান্ত ছিল একেবারে ব্যতিক্রমী—কোটি কোটি তরুণ যেখানে সরকারি চাকরির স্বপ্ন দেখে, সেখানে তিনি সেই সুযোগ প্রত্যাখ্যান করে মৃত্যুর সম্ভাবনাকেই বেছে নেন।

এই সিদ্ধান্ত নেওয়া তাঁর পক্ষে সহজ ছিল না। একদিকে ছিল পরিবারের প্রত্যাশা, উজ্জ্বল ভবিষ্যতের হাতছানি; অন্যদিকে ছিল দেশের প্রতি তাঁর দায়বদ্ধতা, স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামের আহ্বান। তিনি গভীরভাবে উপলব্ধি করছিলেন যে, ব্রিটিশ সরকারের অধীনে চাকরি করে দেশের প্রকৃত সেবা করা সম্ভব নয়। যে ব্রিটিশরা তাঁর দেশকে শৃঙ্খলিত করে রেখেছে, তাদের গোলামি করা তাঁর বিবেকবিরুদ্ধ। এই অন্তর্দ্বন্দ্বের কথা তিনি তাঁর বড়দাদা শরৎচন্দ্র বসুকে লেখা একাধিক চিঠিতে বিস্তারিতভাবে জানিয়েছিলেন। সেইসব চিঠিতে ফুটে উঠেছিল তাঁর গভীর দেশপ্রেম, তাঁর আত্মত্যাগ এবং তাঁর সুদূরপ্রসারী চিন্তাভাবনা।

একটি স্বল্পজ্ঞাত তথ্য:

আইসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতিকালে সুভাষচন্দ্র শুধুমাত্র পাঠ্যপুস্তকের মধ্যেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেননি। তিনি ইংল্যান্ডের রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবন গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতেন এবং সেখানকার শ্রমিক আন্দোলন ও সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। এই অভিজ্ঞতা পরবর্তীকালে তাঁর রাজনৈতিক দর্শনকে প্রভাবিত করেছিল।

অবশেষে, ১৯২১ সালের এপ্রিল মাসে সুভাষচন্দ্র বসু ব্রিটিশ সরকারের ভারত সচিব এডউইন মন্টেগুকে চিঠি লিখে আইসিএস থেকে তাঁর নাম প্রত্যাহার করে নেন। এই পদত্যাগপত্র শুধু একটি চাকরির প্রত্যাখ্যান ছিল না, এটি ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে এক বলিষ্ঠ নৈতিক প্রতিবাদ। তিনি চিঠিতে স্পষ্ট ভাষায় জানিয়েছিলেন যে, এমন একটি সরকারের অধীনে কাজ করা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়, যে সরকার তাঁর দেশের মানুষের উপর দমন-পীড়ন চালায়। এই সিদ্ধান্তের পিছনে তাঁর যুক্তি ছিল অকাট্য – তিনি বিশ্বাস করতেন যে, স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করতে হলে সমস্ত রকম ব্রিটিশ সংস্রব ত্যাগ করা অপরিহার্য।

সুভাষচন্দ্রের এই বৈপ্লবিক সিদ্ধান্ত ভারতে এবং ইংল্যান্ডে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। অনেকেই তাঁর এই “হঠকারী” সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেন, আবার অনেকেই তাঁর সাহস ও দেশপ্রেমের ভূয়সী প্রশংসা করেন। গান্ধীজি থেকে শুরু করে সি. আর. দাশের মতো জাতীয় নেতারা সুভাষের এই আত্মত্যাগকে স্বাগত জানান। এই একটি মাত্র কাজের মাধ্যমে সুভাষচন্দ্র তরুণ সমাজের কাছে এক নতুন আদর্শ স্থাপন করেন। তিনি প্রমাণ করেন যে, ব্যক্তিগত সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ও প্রতিষ্ঠার চেয়েও দেশের স্বাধীনতা অনেক বড়।

আইসিএস ত্যাগের পর সুভাষচন্দ্র আর এক মুহূর্তও ইংল্যান্ডে থাকতে চাননি। তাঁর মন তখন ব্যাকুল হয়ে উঠেছিল স্বদেশের মাটিতে ফিরে এসে স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য। তিনি বুঝতে পারছিলেন, তাঁর আসল কর্মক্ষেত্র ভারত, তাঁর আসল পরিচয় তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা। কেমব্রিজের ডিগ্রি বা আইসিএসের তকমা নয়, তাঁর জীবনের পরম আরাধ্য ছিল দেশমাতৃকার শৃঙ্খল মোচন। এই দৃঢ় সঙ্কল্প বুকে নিয়ে তিনি ভারতের পথে রওনা হলেন, এক নতুন জীবন, এক নতুন সংগ্রামের সন্ধানে।

তাঁর চোখে তখন ভাসছিল এক স্বাধীন, সার্বভৌম, শক্তিশালী ভারতের স্বপ্ন – যে স্বপ্নের বাস্তবায়নের জন্য তিনি তাঁর সমগ্র জীবন উৎসর্গ করতে প্রস্তুত ছিলেন। বিলেতের অভিজ্ঞতা তাঁকে দিয়েছিল আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রেক্ষাপট বোঝার গভীরতা, আর আইসিএস ত্যাগের সিদ্ধান্ত দিয়েছিল নৈতিক superioreority। এই দুই অস্ত্র নিয়েই তিনি প্রবেশ করতে চলেছিলেন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের জটিল ও কণ্টকাকীর্ণ পথে।

রাজনীতির আঙিনায় প্রবেশ গান্ধীজির সঙ্গে পথচলা: এক নতুন পথের সন্ধানে দেশবন্ধু, আমি আপনার সৈনিক

১৯২১ সালের ১৬ই জুলাই। সুভাষচন্দ্র বসু ইংল্যান্ড থেকে ভারতে ফিরে এলেন, হৃদয়ে অদম্য স্বদেশপ্রেম আর চোখে এক স্বাধীন ভারতের স্বপ্ন নিয়ে। জাহাজ থেকে নেমেই তিনি সর্বপ্রথম দেখা করতে চাইলেন তৎকালীন ভারতের অবিসংবাদিত নেতা মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে। বোম্বাইতে তাঁদের প্রথম সাক্ষাৎ হয়।

তরুণ সুভাষের চোখে তখন হাজারো প্রশ্ন, মনে অফুরন্ত উদ্দীপনা। তিনি গান্ধীজির কাছে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের রূপরেখা, তাঁর অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের কার্যকারিতা এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চাইলেন। গান্ধীজিও এই তেজস্বী তরুণের আগ্রহ ও একাগ্রতায় মুগ্ধ হয়েছিলেন, কিন্তু তাঁদের প্রথম আলোচনাতেই কিছু মৌলিক চিন্তাগত পার্থক্যের আভাস পাওয়া যায়। সুভাষ চেয়েছিলেন দ্রুত ও পূর্ণ স্বাধীনতা, যেখানে গান্ধীজি ছিলেন ধীর, পর্যায়ক্রমিক সংস্কার ও অহিংস পথে আস্থাশীল।

গান্ধীজি সুভাষকে পরামর্শ দিলেন বাংলায় গিয়ে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের সঙ্গে দেখা করতে এবং তাঁর নির্দেশনায় কাজ শুরু করতে। গান্ধীজির পরামর্শ শিরোধার্য করে সুভাষচন্দ্র কলকাতায় এলেন এবং দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন। দেশবন্ধুর ব্যক্তিত্ব, তাঁর বাগ্মিতা, তাঁর ত্যাগ এবং সর্বোপরি তাঁর বলিষ্ঠ ও আপোষহীন মনোভাব সুভাষকে গভীরভাবে আকৃষ্ট করে। দেশবন্ধুকে তিনি তাঁর রাজনৈতিক গুরু হিসেবে বরণ করে নিলেন। দেশবন্ধুর স্নেহচ্ছায়ায় সুভাষের রাজনৈতিক জীবনের হাতেখড়ি হল। তিনি দেশবন্ধুকে বলেছিলেন,

“দেশবন্ধু, আমি আপনার সৈনিক। আপনি যা আদেশ করবেন, আমি তাই পালন করব।”

এই সময়টা ছিল ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গান্ধীজির নেতৃত্বে দেশজুড়ে চলছিল অসহযোগ আন্দোলন। সুভাষচন্দ্র পূর্ণ উদ্যমে সেই আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। তিনি প্রথমে কলকাতার ন্যাশনাল কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং যুব সমাজকে স্বাধীনতা সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করতে শুরু করেন। এরপর দেশবন্ধুর স্বরাজ্য পার্টিতে যোগ দিয়ে তিনি দলের প্রচার বিভাগের দায়িত্ব নেন। তাঁর অসাধারণ সাংগঠনিক ক্ষমতা, বাগ্মিতা এবং অক্লান্ত পরিশ্রম অল্পদিনের মধ্যেই তাঁকে বাংলার যুব সমাজের কাছে এক জনপ্রিয় নেতায় পরিণত করে।

১৯২১ সালে প্রিন্স অফ ওয়েলসের ভারত আগমনের প্রতিবাদে দেশব্যাপী হরতাল ও বিক্ষোভ সংগঠিত করার ক্ষেত্রে সুভাষচন্দ্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এই অপরাধে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের সঙ্গে তাঁকেও প্রথমবার কারাবরণ করতে হয়। কারাগারে থাকাকালীন তিনি দেশবন্ধুর আরও ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে আসেন এবং তাঁর কাছ থেকে রাজনৈতিক দর্শনের পাঠ গ্রহণ করেন। কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর তিনি আরও সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন।

একটি স্বল্পজ্ঞাত তথ্য:

সুভাষচন্দ্র বসু যখন প্রথমবার কারারুদ্ধ হন, তখন জেলের মধ্যে তিনি অন্যান্য বন্দীদের জন্য পড়াশোনা ও শরীরচর্চার ব্যবস্থা করেছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, শারীরিক ও মানসিক উভয় দিক থেকেই শক্তিশালী হওয়া প্রয়োজন

১৯২৪ সালে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ যখন কলকাতা কর্পোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হন, তখন তিনি সুভাষচন্দ্রকে কর্পোরেশনের চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার পদে নিযুক্ত করেন। মাত্র ২৭ বছর বয়সে এত গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশাসনিক দায়িত্ব লাভ করা ছিল এক বিরল ঘটনা। সুভাষচন্দ্র অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে এই দায়িত্ব পালন করেন।

তিনি কলকাতার পৌর পরিষেবাগুলির আমূল সংস্কার সাধন করেন, রাস্তাঘাট নির্মাণ, পানীয় জলের সরবরাহ, নিকাশি ব্যবস্থার উন্নতি এবং প্রাথমিক শিক্ষার প্রসারে বিশেষ নজর দেন। তাঁর সময়ে কলকাতা কর্পোরেশন ব্রিটিশ আমলাতন্ত্রের প্রভাবমুক্ত হয়ে এক জনকল্যাণমুখী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। তিনি কর্পোরেশনের সমস্ত নথিপত্র ও কাজকর্ম ইংরেজির পরিবর্তে বাংলায় চালু করার নির্দেশ দেন এবং রাস্তার নামগুলো ইংরেজদের বদলে ভারতীয় মনীষীদের নামে পরিবর্তন করার উদ্যোগ নেন।

কিন্তু সুভাষচন্দ্রের এই ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা এবং তাঁর জাতীয়তাবাদী কার্যকলাপ ব্রিটিশ সরকারের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ১৯২৪ সালের অক্টোবর মাসে ব্রিটিশ সরকার তাঁকে কোনও সুস্পষ্ট কারণ ছাড়াই “বেঙ্গল অর্ডিন্যান্স” নামক এক দমনমূলক আইনের আওতায় আবার গ্রেফতার করে এবং প্রথমে আলিপুর সেন্ট্রাল জেল, তারপর বহরমপুর জেল হয়ে অবশেষে সুদূর ব্রহ্মদেশের (বর্তমান মায়ানমার) মান্দালয় জেলে নির্বাসিত করে।

এই মান্দালয় জেলেই একসময় লোকমান্য তিলককেও বন্দী করে রাখা হয়েছিল। এই নির্বাসনকাল সুভাষচন্দ্রের জীবনে এক কঠিন পরীক্ষা ছিল। শারীরিক ও মানসিক কষ্টের পাশাপাশি নিঃসঙ্গতা তাঁকে গ্রাস করেছিল। কিন্তু এই প্রতিকূল পরিবেশেও তিনি তাঁর মনোবল হারাননি। তিনি প্রচুর পড়াশোনা করতেন, লিখতেন এবং ভবিষ্যৎ সংগ্রামের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতেন।

মান্দালয় জেলে থাকাকালীন তাঁর স্বাস্থ্যের ক্রমশ অবনতি ঘটে। ব্রিটিশ সরকার জনমতের চাপে তাঁকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়, তবে শর্ত ছিল যে তাঁকে চিকিৎসার জন্য ইউরোপে যেতে হবে। ১৯২৭ সালে তিনি জেল থেকে মুক্তি পান। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের অকালমৃত্যু (১৯২৫) সুভাষচন্দ্রের জীবনে এক গভীর শূন্যতা সৃষ্টি করেছিল। রাজনৈতিক গুরুকে হারিয়ে তিনি কিছুটা দিশেহারা বোধ করলেও, হতোদ্যম হননি। বরং, দেশবন্ধুর অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করার দৃঢ় সঙ্কল্প নিয়ে তিনি বাংলার রাজনীতিতে এক নতুন উদ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়েন।

গান্ধীজীর সঙ্গে তাঁর পথচলা শুরু হয়েছিল পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও কিছু মতপার্থক্য নিয়ে, কিন্তু দেশবন্ধুর দেখানো পথই তাঁকে দিয়েছিল নির্দিষ্ট দিশা। এই সময় থেকেই সুভাষচন্দ্র বসু ধীরে ধীরে সর্বভারতীয় রাজনীতিতে তাঁর নিজস্ব স্থান তৈরি করতে শুরু করেন। তাঁর আপোষহীন মনোভাব, তাঁর বিপ্লবী চেতনা এবং তাঁর দূরদর্শী নেতৃত্ব ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করতে চলেছিল।

কংগ্রেসের অভ্যন্তরে নিজস্ব স্বর: মতপার্থক্য সংগ্রাম আপোষ নয়, চাই পূর্ণ স্বাধীনতা

মান্দালয় কারাগার থেকে মুক্তি এবং ইউরোপে স্বল্পকালীন চিকিৎসার পর সুভাষচন্দ্র বসু যখন ভারতে ফিরে এলেন, তখন তিনি আরও পরিণত, আরও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের মৃত্যুতে বাংলার রাজনীতিতে যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছিল, তা পূরণ করার গুরুদায়িত্ব অনেকাংশেই তাঁর কাঁধে এসে পড়ে। এই সময়ে তিনি সর্বভারতীয় কংগ্রেসের রাজনীতিতেও ক্রমশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে থাকেন। তাঁর ক্ষুরধার বুদ্ধি, অসামান্য সাংগঠনিক দক্ষতা এবং আপোষহীন সংগ্রামী মানসিকতা তাঁকে জাতীয় স্তরের নেতৃত্বের প্রথম সারিতে নিয়ে আসে।

১৯২৮ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনে সুভাষচন্দ্র অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এই অধিবেশনে মতিলাল নেহরুর সভাপতিত্বে যে “নেহরু রিপোর্ট” পেশ করা হয়, তাতে ভারতের জন্য “ডোমিনিয়ন স্ট্যাটাস” বা স্বায়ত্তশাসনের দাবি জানানো হয়েছিল।

সুভাষচন্দ্র এবং জওহরলাল নেহরুর মতো তরুণ নেতারা এই প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করেন। তাঁরা চেয়েছিলেন “পূর্ণ স্বরাজ” বা সম্পূর্ণ স্বাধীনতা। এই প্রশ্নে গান্ধীজি সহ কংগ্রেসের প্রবীণ নেতাদের সঙ্গে তাঁদের তীব্র মতপার্থক্য দেখা দেয়। সুভাষচন্দ্র ও জওহরলাল নেহরু মিলিতভাবে “ইন্ডিপেন্ডেন্স ফর ইন্ডিয়া লীগ” (Independence for India League) গঠন করেন, যার মূল লক্ষ্য ছিল পূর্ণ স্বাধীনতার দাবিকে কংগ্রেসের প্রধান দাবিতে পরিণত করা।

এই কলকাতা কংগ্রেসেই সুভাষচন্দ্র “বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স” নামে এক স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন করেন, যার শৃঙ্খলা ও সামরিক সজ্জা সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তিনি নিজে এই বাহিনীর জেনারেল অফিসার কমান্ডিং (GOC) হিসেবে সামরিক পোশাকে কুচকাওয়াজে নেতৃত্ব দেন। এই ঘটনা একদিকে যেমন তাঁর অনুগামীদের মধ্যে বিপুল উৎসাহের সঞ্চার করে, তেমনই অন্যদিকে কংগ্রেসের অহিংস নীতিতে বিশ্বাসী অনেক নেতা, বিশেষত গান্ধীজি, বিষয়টিকে খুব একটা ভালো চোখে দেখেননি।

সুভাষচন্দ্র বসু জীবনী
সুভাষচন্দ্র বসু জীবনী

তাঁদের মনে হয়েছিল, এই ধরনের সামরিক শৃঙ্খলা প্রদর্শন অহিংসার পরিপন্থী। কিন্তু সুভাষচন্দ্র বিশ্বাস করতেন, দেশের যুবসমাজকে শৃঙ্খলাবদ্ধ ও শক্তিশালী করে তোলা স্বাধীনতা অর্জনের জন্য অপরিহার্য।

একটি স্বল্পজ্ঞাত তথ্য:

কলকাতা কংগ্রেসে সুভাষচন্দ্রের সামরিক পোশাকে কুচকাওয়াজ দেখে গান্ধীজি নাকি পরিহাস করে বলেছিলেন, “সার্কাসের সেরা আকর্ষণ!” যদিও সুভাষচন্দ্র বিষয়টিকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গেই নিয়েছিলেন এবং এর মাধ্যমে তিনি তরুণদের মধ্যে এক নতুন উদ্দীপনা জাগাতে চেয়েছিলেন।

মতপার্থক্য সত্ত্বেও, সুভাষচন্দ্রের যোগ্যতা ও জনপ্রিয়তাকে উপেক্ষা করা কংগ্রেস নেতৃত্বের পক্ষে সম্ভব ছিল না। ১৯৩০ সালে গান্ধীজির নেতৃত্বে যখন লবণ সত্যাগ্রহ আন্দোলন শুরু হয়, সুভাষচন্দ্র তখন আইন অমান্য আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন এবং কারারুদ্ধ হন। জেলে থাকাকালীনই তিনি কলকাতার মেয়র নির্বাচিত হন, যা তাঁর জনপ্রিয়তার এক উজ্জ্বল নিদর্শন।

কংগ্রেসের অভ্যন্তরে সুভাষচন্দ্রের উত্থান ছিল উল্কার মতো। তিনি খুব দ্রুত সাধারণ সম্পাদক এবং ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। তাঁর জ্বালাময়ী বক্তৃতা, বলিষ্ঠ নেতৃত্ব এবং আপোষহীন মনোভাব তাঁকে তরুণ প্রজন্মের কাছে এক আইকনে পরিণত করে। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, শুধুমাত্র আবেদন-নিবেদন বা অহিংস আন্দোলনের মাধ্যমে ভারতের স্বাধীনতা অর্জন সম্ভব নয়। ব্রিটিশ শক্তিকে ভারত থেকে উৎখাত করতে হলে আরও সক্রিয় ও বৈপ্লবিক পন্থার আশ্রয় নেওয়া প্রয়োজন। এই প্রশ্নে গান্ধীজির সঙ্গে তাঁর মতপার্থক্য ক্রমশ বাড়তেই থাকে।

গান্ধীজি ছিলেন ধীর, স্থির এবং অহিংস পথে আস্থাশীল। তিনি মনে করতেন, গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে ধীরে ধীরে ব্রিটিশ সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করে স্বাধীনতা অর্জন করতে হবে। অন্যদিকে, সুভাষচন্দ্র ছিলেন অধৈর্য, দ্রুত ফললাভে বিশ্বাসী। তিনি মনে করতেন, আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে এবং প্রয়োজনে সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে ব্রিটিশ শাসনকে উচ্ছেদ করতে হবে। এই মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্যই পরবর্তীকালে কংগ্রেসের অভ্যন্তরে সুভাষচন্দ্রের সঙ্গে গান্ধীজি ও তাঁর অনুগামীদের সংঘাতের মূল কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

তাঁদের মধ্যে মতপার্থক্য থাকলেও, ব্যক্তিগত স্তরে গান্ধীজি সুভাষচন্দ্রকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন এবং তাঁর দেশপ্রেম ও আত্মত্যাগের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। সুভাষচন্দ্রও গান্ধীজিকে “জাতির জনক” হিসেবে সম্মান করতেন, কিন্তু রাজনৈতিক কৌশলের প্রশ্নে তিনি নিজের বিশ্বাসে অটল ছিলেন। তিনি প্রায়শই বলতেন,

“আমরা যদি আরও একশো বছর ধরে শুধু চরকা কাটি, তাহলেও স্বাধীনতা আসবে না।”

এই ধরনের মন্তব্য গান্ধীজির অনুগামীদের ক্ষুব্ধ করত, কিন্তু সুভাষচন্দ্র তাঁর সত্য ভাষণে কখনও দ্বিধা করেননি।

তিনি চেয়েছিলেন কংগ্রেসকে একটি আপোষহীন সংগ্রামী সংগঠনে পরিণত করতে, যা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রামে নেতৃত্ব দেবে। এই লক্ষ্যেই তিনি কংগ্রেসের অভ্যন্তরে তাঁর নিজস্ব স্বর ক্রমশ জোরালো করে তুলতে থাকেন, যা অনিবার্যভাবেই তাঁকে এক বৃহত্তর সংঘাতের দিকে ঠেলে দিচ্ছিল।

ইউরোপে নির্বাসন বিশ্ব রাজনীতির পাঠ শত্রুর শত্রু আমার মিত্র

১৯৩০-এর দশকের প্রথম দিকে সুভাষচন্দ্রের বিপ্লবী কার্যকলাপ এবং তাঁর ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা ব্রিটিশ সরকারের জন্য এক বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সরকার তাঁকে বিপজ্জনক ব্যক্তি হিসেবে চিহ্নিত করে এবং তাঁর গতিবিধির উপর কড়া নজর রাখতে শুরু করে। বারবার কারাবাস তাঁর স্বাস্থ্য ভেঙে দিচ্ছিল। ১৯৩২ সালে তাঁর স্বাস্থ্যের গুরুতর অবনতি ঘটলে, ব্রিটিশ সরকার তাঁকে চিকিৎসার জন্য ইউরোপে যাওয়ার অনুমতি দেয়, তবে শর্ত ছিল যে তিনি সেখানে কোনও রাজনৈতিক কার্যকলাপ চালাতে পারবেন না। এইভাবেই কার্যত এক নির্বাসিত জীবন শুরু হয় সুভাষচন্দ্রের।

ইউরোপের এই প্রবাসকাল (১৯৩৩-১৯৩৬) সুভাষচন্দ্রের জীবনে এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এই সময়ে তিনি শুধুমাত্র শারীরিক আরোগ্য লাভের চেষ্টাই করেননি, বরং ইউরোপের তৎকালীন জটিল রাজনৈতিক পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ করার সুযোগ পান।

তিনি ভিয়েনা, জেনেভা, রোম, বার্লিন, ডাবলিন সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ শহরে ভ্রমণ করেন এবং বহু রাষ্ট্রনেতা, কূটনীতিক, সমাজতাত্ত্বিক ও বুদ্ধিজীবীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তাঁর মূল উদ্দেশ্য ছিল ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায় করা এবং বিভিন্ন দেশের মুক্তি আন্দোলন সম্পর্কে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা অর্জন করা।

ভিয়েনাতে থাকাকালীন তিনি প্রখ্যাত সমাজতাত্ত্বিক ও লেখক ভিত্তালভাই প্যাটেলের (সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের অগ্রজ) ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে আসেন। ভিত্তালভাই প্যাটেলও তখন অসুস্থ শরীরে ভিয়েনাতে ছিলেন। ভারতের স্বাধীনতা নিয়ে তাঁদের মধ্যে দীর্ঘ আলোচনা হয়। তাঁরা দুজনেই এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, শুধুমাত্র অহিংস আন্দোলনের মাধ্যমে ভারতের স্বাধীনতা অর্জন কঠিন এবং আন্তর্জাতিক সাহায্য ও প্রচার অত্যন্ত জরুরি। তাঁদের যৌথ বিবৃতিতে (প্যাটেল-বোস মেনিফেস্টো) গান্ধীজির নেতৃত্বের সমালোচনা করা হয় এবং ভারতের মুক্তি সংগ্রামে আরও সক্রিয় ও বলিষ্ঠ পদক্ষেপের আহ্বান জানানো হয়। এই বিবৃতি কংগ্রেসের অভ্যন্তরে তীব্র বিতর্কের সৃষ্টি করে।

সুভাষচন্দ্র ইতালির একনায়ক বেনিতো মুসোলিনির সঙ্গে কয়েকবার সাক্ষাৎ করেন। মুসোলিনি ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি সহানুভূতি দেখালেও, কোনও প্রত্যক্ষ সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেননি। জার্মানিতে তিনি নাৎসি নেতৃত্বের সঙ্গেও যোগাযোগের চেষ্টা করেন, কিন্তু হিটলারের ভারত-বিরোধী এবং বর্ণবিদ্বেষী মনোভাব তাঁকে হতাশ করে। তবে, তিনি জার্মানিতে বসবাসকারী কিছু ভারতীয় বিপ্লবী এবং জাতীয়তাবাদী নেতার সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করেন। আয়ারল্যান্ডের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস তাঁকে বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করে। তিনি আইরিশ নেতা ইমোন ডি ভ্যালেরার সঙ্গে দেখা করেন এবং আয়ারল্যান্ডের মুক্তি সংগ্রামের কৌশল সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেন।

একটি স্বল্পজ্ঞাত তথ্য:

ইউরোপে থাকাকালীন সুভাষচন্দ্র “দ্য ইন্ডিয়ান স্ট্রাগল” (The Indian Struggle, 1920-1934) নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন, যেখানে তিনি ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস এবং তাঁর নিজস্ব রাজনৈতিক চিন্তাভাবনা তুলে ধরেন। ব্রিটিশ সরকার ভারতে এই বইটির প্রবেশ নিষিদ্ধ করে দিয়েছিল, কারণ তারা মনে করেছিল বইটি রাজদ্রোহমূলক এবং বিপ্লবী ভাবধারায় পরিপূর্ণ

ইউরোপে থাকাকালীন সুভাষচন্দ্র বিভিন্ন দেশের সমাজতান্ত্রিক ও বামপন্থী আন্দোলনের প্রতিও আকৃষ্ট হন। তিনি উপলব্ধি করেন যে, ভারতের ভবিষ্যৎ শুধুমাত্র রাজনৈতিক স্বাধীনতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠা করাও একান্ত প্রয়োজন। তিনি একটি শক্তিশালী, সমাজবাদী ও ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের স্বপ্ন দেখতেন, যেখানে কোনও শোষণ বা ভেদাভেদ থাকবে না।

এই সময়েই তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় এমিলি শেঙ্কল (Emilie Schenkl) নামে এক অস্ট্রিয়ান মহিলার, যিনি পরবর্তীকালে তাঁর সচিব এবং জীবনসঙ্গিনী হয়েছিলেন। তাঁদের এই সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত ব্যক্তিগত এবং লোকচক্ষুর অন্তরালে।

ইউরোপের এই নির্বাসনকাল সুভাষচন্দ্রকে আন্তর্জাতিক রাজনীতির জটিল সমীকরণগুলি হাতে-কলমে শেখার সুযোগ করে দিয়েছিল। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, শুধুমাত্র অভ্যন্তরীণ সংগ্রামই যথেষ্ট নয়, আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিকে নিজেদের অনুকূলে ব্যবহার করতে পারাটাও জরুরি।

“শত্রুর শত্রু আমার মিত্র”

– এই কূটনীতির প্রাথমিক পাঠ তিনি এখানেই গ্রহণ করেন, যা পরবর্তীকালে আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠনের সময় তাঁর প্রধান রণকৌশল হয়ে উঠেছিল। স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারের পাশাপাশি, এই সময়টা ছিল তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতা অর্জনের কাল।

তিনি তখন আর শুধু বাংলার বা ভারতের নেতা নন, তিনি হয়ে উঠছিলেন এক আন্তর্জাতিক স্তরের রাষ্ট্রনায়ক, যাঁর দৃষ্টি ছিল সুদূরপ্রসারী। এই অভিজ্ঞতা নিয়েই তিনি ভারতে ফিরে আসার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠেন, কারণ তাঁর মন বলছিল, দেশের মাটিতে তাঁর জন্য আরও বড় ভূমিকা অপেক্ষা করছে।

কংগ্রেস সভাপতি ও ত্রিপুরী সংকট: এক ঐতিহাসিক মোড় – “আমি আপোষ করতে আসিনি”

ইউরোপে কয়েক বছর নির্বাসিত জীবন কাটানোর পর সুভাষচন্দ্র বসু ১৯৩৮ সালে দেশে ফেরেন। ততদিনে তিনি ভারতের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের এক অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত হয়েছেন। তাঁর আপোষহীন সংগ্রাম, তাঁর বলিষ্ঠ নেতৃত্ব এবং তাঁর আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গি তাঁকে কংগ্রেসের তরুণ প্রজন্মের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় করে তুলেছিল। এই জনপ্রিয়তার ফলস্বরূপ, ১৯৩৮ সালে হরিপুরাতে অনুষ্ঠিত জাতীয় কংগ্রেসের ৫১তম অধিবেশনে সুভাষচন্দ্র সর্বসম্মতিক্রমে কংগ্রেস সভাপতি নির্বাচিত হন। গান্ধীজি স্বয়ং তাঁর নাম প্রস্তাব করেছিলেন।

কংগ্রেস সভাপতি হিসেবে সুভাষচন্দ্র এক নতুন উদ্দীপনা ও কর্মচাঞ্চল্য নিয়ে আসেন। তিনি কংগ্রেসকে একটি শক্তিশালী ও সুসংগঠিত গণআন্দোলনের যন্ত্র হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। তাঁর সভাপতির ভাষণে তিনি ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি পুনরায় জোরালোভাবে তুলে ধরেন এবং ভবিষ্যৎ ভারতের জন্য এক বিস্তারিত পরিকল্পনা পেশ করেন, যেখানে জাতীয় পরিকল্পনা কমিশন গঠন, দ্রুত শিল্পায়ন, ভূমি সংস্কার এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছিল। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে, স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর কীভাবে দেশ গঠন করতে হবে, তার রূপরেখা আগে থেকেই প্রস্তুত রাখা দরকার।

সুভাষচন্দ্র বিশ্বাস করতেন যে, আসন্ন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সুযোগ নিয়ে ব্রিটিশদের উপর চরম আঘাত হানা প্রয়োজন। তিনি ব্রিটিশ সরকারকে একটি নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়ার জন্য চরমপত্র (ultimatum) দেওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন। যদি ব্রিটিশ সরকার সেই দাবি না মানে, তাহলে দেশব্যাপী এক ব্যাপক গণ-আন্দোলন শুরু করার পরিকল্পনা ছিল তাঁর। কিন্তু তাঁর এই আগ্রাসী ও আপোষহীন মনোভাবে কংগ্রেসের দক্ষিণপন্থী নেতারা, বিশেষত যাঁরা গান্ধীজির অহিংস নীতির প্রতি পূর্ণ আস্থাশীল ছিলেন, তাঁরা শঙ্কিত হয়ে ওঠেন। গান্ধীজিও সুভাষচন্দ্রের এই চরমপন্থী কার্যকলাপে সম্পূর্ণ সহমত ছিলেন না।

এই মতপার্থক্যের মধ্যেই ১৯৩৯ সালে কংগ্রেসের পরবর্তী সভাপতি নির্বাচনের সময় আসে। সুভাষচন্দ্র পুনরায় সভাপতি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সিদ্ধান্ত নেন। গান্ধীজি এবং কংগ্রেসের দক্ষিণপন্থী গোষ্ঠী সুভাষচন্দ্রের পুনর্নির্বাচনের ঘোর বিরোধী ছিলেন। গান্ধীজি তাঁর মনোনীত প্রার্থী হিসেবে পট্টভি সীতারামাইয়াকে দাঁড় করান। এই নির্বাচন ঘিরে কংগ্রেসের অভ্যন্তরে তীব্র মেরুকরণ দেখা দেয়। একদিকে ছিলেন সুভাষচন্দ্র ও তাঁর অনুগামী বামপন্থী ও তরুণ সমাজ, অন্যদিকে ছিলেন গান্ধীজি ও তাঁর সমর্থক দক্ষিণপন্থী ও প্রবীণ নেতারা।

নির্বাচনে সুভাষচন্দ্র বসু গান্ধীজির মনোনীত প্রার্থী পট্টভি সীতারামাইয়াকে পরাজিত করে বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন। এই জয় ছিল সুভাষচন্দ্রের ব্যক্তিগত ক্যারিশমা এবং তাঁর নীতির প্রতি জনগণের সমর্থনের প্রমাণ। কিন্তু এই জয় একইসঙ্গে কংগ্রেসের অভ্যন্তরে এক গভীর সংকটেরও জন্ম দেয়, যা “ত্রিপুরী সংকট” নামে পরিচিত। গান্ধীজি পট্টভি সীতারামাইয়ার পরাজয়কে নিজের পরাজয় হিসেবে গণ্য করেন এবং বলেন, “Pattabhi’s defeat is my defeat.” এই মন্তব্যের পর কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির বেশিরভাগ সদস্য, যাঁরা গান্ধীজির অনুগামী ছিলেন, তাঁরা একযোগে পদত্যাগ করেন। ফলে, সুভাষচন্দ্র সভাপতি নির্বাচিত হলেও, কার্যকরীভাবে কোনও কাজ করতে পারছিলেন না।

একটি স্বল্পজ্ঞাত তথ্য:

ত্রিপুরী কংগ্রেসের অধিবেশনে সুভাষচন্দ্র প্রচণ্ড জ্বরে আক্রান্ত ছিলেন। অসুস্থ শরীরে স্ট্রেচারে শুয়েই তিনি অধিবেশনে যোগ দেন এবং ভাষণ দেন। তাঁর এই শারীরিক অসুস্থতা সত্ত্বেও মানসিক দৃঢ়তা সকলকে অবাক করে দিয়েছিল।

ত্রিপুরী অধিবেশনে সুভাষচন্দ্র চেয়েছিলেন কংগ্রেসের সকল গোষ্ঠী মিলিতভাবে কাজ করুক এবং একটি জাতীয় ঐক্যের সরকার গঠন করে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত সংগ্রাম শুরু করুক। কিন্তু গান্ধীজি ও তাঁর অনুগামীরা সুভাষচন্দ্রের সঙ্গে কোনওরকম সহযোগিতা করতে অস্বীকার করেন। তাঁরা দাবি করেন যে, সুভাষচন্দ্র যেন গান্ধীজির ইচ্ছানুযায়ী ওয়ার্কিং কমিটি গঠন করেন। সুভাষচন্দ্রের পক্ষে এই শর্ত মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না, কারণ এর অর্থ ছিল নিজের নীতি ও আদর্শের সঙ্গে আপোষ করা। এই অচলাবস্থা নিরসনের কোনও পথ খুঁজে না পেয়ে, অবশেষে ১৯৩৯ সালের এপ্রিল মাসে সুভাষচন্দ্র কংগ্রেস সভাপতির পদ থেকে ইস্তফা দেন।

এই ঘটনা ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এক দুর্ভাগ্যজনক অধ্যায়। সুভাষচন্দ্রের মতো একজন দূরদর্শী ও বলিষ্ঠ নেতাকে কংগ্রেসের নেতৃত্ব থেকে সরে যেতে বাধ্য করা হয়, যা নিঃসন্দেহে স্বাধীনতা আন্দোলনকে দুর্বল করেছিল। কিন্তু সুভাষচন্দ্র হতোদ্যম হননি। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, কংগ্রেসের অভ্যন্তরে থেকে তাঁর পক্ষে আপোষহীন সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। তাই, কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে এসে তিনি “ফরওয়ার্ড ব্লক” (Forward Bloc) নামে একটি নতুন দল গঠন করেন, যার মূল লক্ষ্য ছিল ভারতের সকল বামপন্থী ও সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে এক নির্ণায়ক সংগ্রাম শুরু করা।

ত্রিপুরী সংকট ছিল সুভাষচন্দ্রের রাজনৈতিক জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ মোড়। এই ঘটনার পর তিনি কংগ্রেসের নরমপন্থী ও আপোষকামী রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেন এবং এক নিজস্ব, স্বাধীন পথে ভারতের মুক্তির জন্য সংগ্রাম শুরু করার প্রস্তুতি নিতে থাকেন।

তাঁর সামনে তখন এক অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ, কিন্তু তাঁর হৃদয়ে ছিল অদম্য সাহস আর চোখে ছিল এক স্বাধীন ভারতের স্বপ্ন – যে স্বপ্নের জন্য তিনি যেকোনো ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত ছিলেন। এই পথই তাঁকে নিয়ে যাবে এক দুঃসাহসিক অভিযানের দিকে, যা তাঁকে করে তুলবে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের এক অমর কিংবদন্তি – নেতাজি।

মহানিষ্ক্রমণ: কিংবদন্তির জন্ম আমি ফিরব, স্বাধীনতার সূর্য নিয়ে

কংগ্রেস সভাপতির পদ থেকে ইস্তফা এবং ফরওয়ার্ড ব্লক গঠনের পর সুভাষচন্দ্র বসু ব্রিটিশ সরকারের আরও বেশি রোষানলে পড়েন। তাঁর আপোষহীন সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী অবস্থান এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সুযোগ নিয়ে গণ-আন্দোলন শুরু করার পরিকল্পনা ব্রিটিশ শাসকদের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল।

১৯৪০ সালের জুলাই মাসে ‘হলওয়েল মনুমেন্ট’ অপসারণ আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার অভিযোগে তাঁকে আবার গ্রেফতার করা হয় এবং কলকাতার প্রেসিডেন্সি জেলে অন্তরীণ রাখা হয়। জেলে থাকাকালীন তিনি আমরণ অনশন শুরু করেন। তাঁর শারীরিক অবস্থার দ্রুত অবনতি হতে থাকলে ব্রিটিশ সরকার বাধ্য হয়ে তাঁকে মুক্তি দেয়, কিন্তু শর্তসাপেক্ষে – তাঁকে কলকাতার এলগিন রোডের বাড়িতে গৃহবন্দী থাকতে হবে। দিনরাত ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের কড়া নজরদারি চলত তাঁর বাড়ির আশেপাশে।

কিন্তু সুভাষচন্দ্রকে এভাবে আটকে রাখা অসম্ভব ছিল। তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন, ব্রিটিশদের কবল থেকে দেশকে মুক্ত করতে হলে দেশের বাইরে গিয়ে আন্তর্জাতিক শক্তির সাহায্য নিয়ে এক সশস্ত্র সংগ্রাম গড়ে তোলা অপরিহার্য। গৃহবন্দী থাকাকালীন তিনি গোপনে তাঁর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার ছক কষতে শুরু করেন। তাঁর এই দুঃসাহসিক পরিকল্পনার কথা জানতেন শুধুমাত্র কয়েকজন বিশ্বস্ত অনুগামী, যাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন তাঁর ভাইপো শিশিরকুমার বসু।

অবশেষে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ উপস্থিত হল। ১৯৪১ সালের ১৬ই জানুয়ারি, গভীর রাতে, সুভাষচন্দ্র বসু ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের চোখে ধুলো দিয়ে তাঁর এলগিন রোডের বাড়ি থেকে আশ্চর্যজনকভাবে অন্তর্ধান করেন।

তিনি বেছে নিয়েছিলেন এক পাঠান যুবক, মহম্মদ জিয়াউদ্দিনের ছদ্মবেশ। ঘন দাড়ি, চোখে সুরমা, পরনে কাবুলি পোশাক – এই রূপে তাঁকে চেনা প্রায় অসম্ভব ছিল। তাঁর ভাইপো শিশিরকুমার বসু একটি জার্মান ওয়ান্ডারার গাড়িতে করে তাঁকে প্রথমে গোমো পর্যন্ত পৌঁছে দেন। সেখান থেকে ট্রেনে পেশোয়ার, তারপর কাবুলের দুর্গম পথে যাত্রা। এই মহানিষ্ক্রমণ ছিল এক অবিশ্বাস্য সাহসিকতা ও বুদ্ধিমত্তার পরিচয়। প্রতিটি মুহূর্তে ছিল ধরা পড়ার আশঙ্কা, প্রতিটি পদক্ষেপে ছিল জীবননাশের ঝুঁকি। কিন্তু সুভাষচন্দ্রের হৃদয়ে ছিল অদম্য সঙ্কল্প – যে কোনো মূল্যে ভারতের মুক্তির জন্য লড়াই চালিয়ে যেতে হবে।

পথ:
কলকাতা → বিহার → পাটনা → পুরুলিয়া → নাগপুর → ভোপাল → দিল্লি → লাহোর → কাবুল → মস্কো → বার্লিন।

এই পুরো পালানোর পরিকল্পনা ছিল গোপন, নাটকীয় এবং অবিশ্বাস্য।

কাবুলে পৌঁছানোর পর তাঁর যাত্রাপথ আরও কঠিন হয়ে ওঠে। সেখানে তিনি বেশ কিছুদিন আত্মগোপন করে থাকেন এবং বিভিন্ন দেশের দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেন।

অবশেষে, ইতালীয় দূতাবাসের সাহায্যে তিনি “অরল্যান্ডো মাজ্জোট্টা” (Orlando Mazzotta) নামে এক ইতালীয় ডিপ্লোম্যাটের (diplomat) ছদ্মবেশে আফগানিস্তান থেকে রাশিয়া হয়ে জার্মানির বার্লিনে পৌঁছান। এই সম্পূর্ণ যাত্রাপথটি ছিল বিপদসঙ্কুল এবং অনিশ্চয়তায় ভরা। কিন্তু সুভাষচন্দ্রের অদম্য ইচ্ছাশক্তি এবং তাঁর অনুগামীদের নিঃস্বার্থ সহযোগিতা এই অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলেছিল।

একটি স্বল্পজ্ঞাত তথ্য:

গৃহবন্দী থাকাকালীন সুভাষচন্দ্র যোগসাধনা ও আধ্যাত্মিক চর্চায় গভীরভাবে মনোনিবেশ করেছিলেন। শোনা যায়, তিনি অদৃশ্য হওয়ার আগে বেশ কিছুদিন মৌনব্রতও পালন করেন। তাঁর মহানিষ্ক্রমণের পরিকল্পনায় এই আধ্যাত্মিক প্রস্তুতিও এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল বলে অনেকে মনে করেন।

সুভাষচন্দ্রের এই অন্তর্ধানের খবর ব্রিটিশ সরকারকে স্তম্ভিত করে দেয়। তারা কিছুতেই বুঝতে পারছিল না, কীভাবে এমন কড়া নজরদারির মধ্যেও সুভাষচন্দ্র পালাতে সক্ষম হলেন। এই ঘটনা সারা ভারতে এক অভূতপূর্ব আলোড়ন সৃষ্টি করে। মানুষের মনে সুভাষচন্দ্র এক কিংবদন্তি নায়কে পরিণত হন। তাঁর এই দুঃসাহসিক অভিযান তরুণ সমাজকে গভীরভাবে অনুপ্রাণিত করে। সকলে বিশ্বাস করতে শুরু করে যে, এই মানুষটিই পারবেন ব্রিটিশদের কবল থেকে দেশকে মুক্ত করতে।

মহানিষ্ক্রমণ শুধু একটি পালানোর ঘটনা ছিল না, এটি ছিল সুভাষচন্দ্রের রাজনৈতিক দূরদর্শিতা এবং তাঁর অসামান্য সাংগঠনিক ক্ষমতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তিনি প্রমাণ করেছিলেন যে, কোনো বাধাই তাঁর পথের অন্তরায় হতে পারে না। তাঁর এই পদক্ষেপ ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে – যে অধ্যায়ে তিনি দেশের সীমানা পেরিয়ে আন্তর্জাতিক মঞ্চে ভারতের মুক্তির জন্য লড়াই শুরু করবেন।

তাঁর সেই বিখ্যাত উক্তি,

“আমি ফিরব, স্বাধীনতার সূর্য নিয়ে,”

তখন লক্ষ লক্ষ ভারতবাসীর হৃদয়ে নতুন আশার সঞ্চার করেছিল। এই মহানিষ্ক্রমণের মধ্যে দিয়েই জন্ম নিয়েছিল এক অজেয় কিংবদন্তি – নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু।

বার্লিনের দিনগুলি আজাদ হিন্দ রেডিও ভারতবাসী, আমি সুভাষ বলছি…”

১৯৪১ সালের এপ্রিল মাসের শুরুতে এক দীর্ঘ, বিপদসঙ্কুল ও রোমাঞ্চকর যাত্রাপথ পেরিয়ে সুভাষচন্দ্র বসু অবশেষে জার্মানির রাজধানী বার্লিনে পৌঁছান। তাঁর ছদ্মনাম তখন অরল্যান্ডো মাজ্জোট্টা।

বার্লিনে এসে তিনি জার্মান সরকারের উচ্চপদস্থ আধিকারিকদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেন এবং ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে জার্মানির সাহায্য প্রার্থনা করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তখন পুরোদমে চলছে। জার্মানি ও তার সহযোগী অক্ষশক্তিগুলি ছিল ব্রিটেনের প্রধান শত্রু। সুভাষচন্দ্র এই আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিকে ভারতের স্বাধীনতার অনুকূলে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন, “শত্রুর শত্রু আমার মিত্র” – এই নীতি অনুসরণ করে।

জার্মানিতে সুভাষচন্দ্রকে যথেষ্ট সম্মানের সঙ্গেই গ্রহণ করা হয়। জার্মান বিদেশ মন্ত্রকের তত্ত্বাবধানে তিনি “স্পেশাল ব্যুরো ফর ইন্ডিয়া” (Special Bureau for India) বা “ভারতীয় দপ্তর” স্থাপন করেন, যা পরবর্তীকালে “ফ্রি ইন্ডিয়া সেন্টার” (Free India Centre) বা “আজাদ হিন্দ কেন্দ্র” নামে পরিচিত হয়।

এই কেন্দ্রের মাধ্যমে তিনি ইউরোপে বসবাসকারী ভারতীয়দের সংগঠিত করা এবং ভারতের স্বাধীনতার সপক্ষে প্রচারকার্য চালানো শুরু করেন। এখানেই প্রথম “জয় হিন্দ” ধ্বনিটিকে জাতীয় অভিবাদন হিসেবে গ্রহণ করা হয় এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “জনগণমন” গানটিকে জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তেরঙা পতাকার মাঝে একটি লম্ফমান বাঘের ছবি দিয়ে আজাদ হিন্দের নিজস্ব পতাকাও তৈরি করা হয়।

সুভাষচন্দ্রের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল দুটি: প্রথমত, অক্ষশক্তির সাহায্যে একটি ভারতীয় সেনাবাহিনী গঠন করা, যা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে; এবং দ্বিতীয়ত, প্রচারকার্যের মাধ্যমে ভারতীয় জনগণের মধ্যে ব্রিটিশ-বিরোধী চেতনা জাগ্রত করা এবং তাঁদেরকে স্বাধীনতা সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করা।

এই দ্বিতীয় উদ্দেশ্য পূরণের জন্য তিনি জার্মান সরকারের সহযোগিতায় “আজাদ হিন্দ রেডিও” (Azad Hind Radio) প্রতিষ্ঠা করেন। এই রেডিও স্টেশন থেকে নিয়মিতভাবে বাংলা, হিন্দি, ইংরেজি, তামিল, তেলুগু, গুজরাটি, ফার্সি এবং পশতু ভাষায় অনুষ্ঠান সম্প্রচার করা হত। সুভাষচন্দ্র নিজে এই রেডিওতে ভাষণ দিতেন। তাঁর সেই উদাত্ত কণ্ঠস্বর,

“ভারতবাসী, আমি সুভাষ বলছি…”

তখন পরাধীন ভারতের লক্ষ লক্ষ মানুষের হৃদয়ে আশার আলো জ্বালিয়েছিল। তাঁর ভাষণগুলি ছিল তেজোদীপ্ত, প্রেরণাদায়ক এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে তীব্র আক্রমণাত্মক।

একটি স্বল্পজ্ঞাত তথ্য:

আজাদ হিন্দ রেডিওর অনুষ্ঠানগুলি এমনভাবে পরিকল্পনা করা হতো যাতে তা ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশনের (BBC) প্রচারের পাল্টা জবাব দিতে পারে। সুভাষচন্দ্র নিজে খবরের বিষয়বস্তু এবং ভাষণের খসড়া তৈরিতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতেন। তিনি চাইতেন, তাঁর বার্তা যেন প্রতিটি ভারতবাসীর কাছে নির্ভুলভাবে পৌঁছায়।

জার্মানিতে থাকাকালীন সুভাষচন্দ্র উত্তর আফ্রিকায় ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীর যে সমস্ত সৈনিক অক্ষশক্তির হাতে যুদ্ধবন্দী হয়েছিলেন, তাঁদেরকে নিয়ে একটি “ইন্ডিয়ান লিজিয়ন” (Indian Legion) বা “ভারতীয় সৈন্যদল” (যাকে অনেকে ‘ফ্রি ইন্ডিয়া লিজিয়ন’ বা ‘টাইগার্স লিজিয়ন’ও বলত) গঠন করার উদ্যোগ নেন।

প্রায় তিন হাজার ভারতীয় যুদ্ধবন্দী এই সৈন্যদলে যোগ দিয়েছিলেন। তাঁদেরকে জার্মান সামরিক অফিসারদের তত্ত্বাবধানে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। যদিও এই সৈন্যদল সরাসরি ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বড় কোনো সামরিক অভিযানে অংশ নিতে পারেনি, তবুও এটি ছিল সুভাষচন্দ্রের নেতৃত্বে গঠিত প্রথম ভারতীয় সেনাবাহিনী, যা ভারতের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করতে প্রস্তুত ছিল।

তবে, জার্মান সরকারের সঙ্গে সুভাষচন্দ্রের সম্পর্ক সবসময় খুব মসৃণ ছিল না। হিটলার এবং নাৎসি নেতৃত্বের একাংশ ভারতের স্বাধীনতা সম্পর্কে খুব একটা উৎসাহী ছিলেন না। তাঁদের মূল লক্ষ্য ছিল নিজেদের সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ চরিতার্থ করা।

নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর জীবনী ও অজানা গল্প।
নেতাজী ও হিটলার

সুভাষচন্দ্র এই বিষয়টি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন এবং তিনি শুধুমাত্র জার্মানির উপর নির্ভরশীল না থেকে অন্যান্য বিকল্প পথের সন্ধান করছিলেন। হিটলারের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাতের অভিজ্ঞতাও খুব একটা সুখকর হয়নি। হিটলারের ভারত-বিরোধী এবং বর্ণবিদ্বেষী মনোভাব সুভাষচন্দ্রকে হতাশ করেছিল।

তা সত্ত্বেও, বার্লিনের দিনগুলি সুভাষচন্দ্রের জীবনে এক গুরুত্বপূর্ণ অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের সময় ছিল। তিনি আন্তর্জাতিক কূটনীতি, প্রচারকার্য এবং সামরিক সংগঠন পরিচালনার বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। তিনি প্রমাণ করেন যে, শুধুমাত্র আলোচনার টেবিলে নয়, প্রয়োজনে যুদ্ধক্ষেত্রেও তিনি ভারতের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করতে প্রস্তুত।

আজাদ হিন্দ রেডিও এবং ইন্ডিয়ান লিজিয়ন ছিল তাঁর সেই সঙ্কল্পের প্রথম মূর্ত প্রতীক। কিন্তু তাঁর দৃষ্টি ছিল আরও দূরে – প্রাচ্যের রণাঙ্গনে, যেখানে জাপানের ক্রমবর্ধমান শক্তি এক নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করছিল। তিনি বুঝতে পারছিলেন, ভারতের মুক্তি আসবে প্রাচ্য থেকেই। তাই, বার্লিনের কর্মকাণ্ড একটি নির্দিষ্ট পর্যায়ে পৌঁছানোর পর তিনি আরও এক দুঃসাহসিক অভিযানের জন্য প্রস্তুত হতে থাকেন।

পূর্ব এশিয়ায় আগমন আজাদ হিন্দ ফৌজের পুনর্গঠন রক্ত দিয়ে স্বাধীনতা কিনতে হবে

জার্মানিতে থাকাকালীন সুভাষচন্দ্র বসু উপলব্ধি করছিলেন যে, ইউরোপের রণাঙ্গন থেকে সরাসরি ভারতের উপর সামরিক অভিযান চালানো প্রায় অসম্ভব। হিটলারের কাছ থেকে ভারতের স্বাধীনতা অর্জনে কার্যকরী সাহায্য পাওয়ার সম্ভাবনাও ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে আসছিল।

ঠিক এই সময়েই প্রাচ্যে জাপানের অভাবনীয় সামরিক সাফল্য এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। জাপান দ্রুতগতিতে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ব্রিটিশ ও অন্যান্য ইউরোপীয় উপনিবেশগুলি দখল করে নিচ্ছিল। এই পরিস্থিতিতে সুভাষচন্দ্র সিদ্ধান্ত নেন যে, তাঁর কর্মক্ষেত্র ইউরোপ থেকে সরিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় নিয়ে যেতে হবে।

এই সিদ্ধান্ত কার্যকর করা ছিল অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। আটলান্টিক ও ভারত মহাসাগর তখন মিত্রশক্তির নৌবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। আকাশপথে যাত্রাও ছিল অসম্ভব। অবশেষে, জার্মান ও জাপানি নৌবাহিনীর যৌথ উদ্যোগে এক দুঃসাহসিক পরিকল্পনার মাধ্যমে সুভাষচন্দ্রকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়।

১৯৪৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি একটি জার্মান ইউ-বোট (ডুবোজাহাজ) U-180-এ চেপে উত্তর জার্মানির কিয়েল বন্দর থেকে যাত্রা শুরু করেন। এই যাত্রাপথে তাঁর সঙ্গী ছিলেন আবিদ হাসান সাফরানি।

উত্তাল আটলান্টিক পেরিয়ে, আফ্রিকার দক্ষিণ প্রান্ত ঘুরে তাঁরা মাদাগাস্কারের কাছে ভারত মহাসাগরে পৌঁছান। সেখানে জার্মান ডুবোজাহাজ থেকে তাঁদেরকে একটি জাপানি ডুবোজাহাজ I-29-এ স্থানান্তরিত করা হয়। এই ধরনের ডুবোজাহাজ থেকে ডুবোজাহাজে সেনা হস্তান্তর যুদ্ধের ইতিহাসে এক বিরল ঘটনা। আরও কয়েক সপ্তাহের বিপদসঙ্কুল সমুদ্রযাত্রার পর, ১৯৪৩ সালের মে মাসে তাঁরা জাপানের অধীন সুমাত্রার সাবাং দ্বীপে (অন্যমতে টোকিওতে) অবতরণ করেন। প্রায় তিন মাসের এই ডুবোজাহাজ যাত্রা ছিল এক অবিশ্বাস্য ও শ্বাসরুদ্ধকর অভিযান।

আজাদ হিন্দ ফৌজ
আজাদ হিন্দ ফৌজ

একটি স্বল্পজ্ঞাত তথ্য:

ডুবোজাহাজে এই দীর্ঘ ও একাকী যাত্রাপথে সুভাষচন্দ্র প্রচুর পড়াশোনা করতেন এবং ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করতেন। আবিদ হাসানের স্মৃতিচারণ থেকে জানা যায়, এই সময়ে সুভাষচন্দ্র আত্মজীবনী লেখার কথাও ভেবেছিলেন এবং কিছু খসড়াও তৈরি করেছিলেন।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সুভাষচন্দ্রের আগমন প্রবাসী ভারতীয় এবং যুদ্ধবন্দীদের মধ্যে এক অভূতপূর্ব উদ্দীপনার সঞ্চার করে। সেই সময়ে জাপানের সহযোগিতায় ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে রাসবিহারী বসু (বিপ্লবী নেতা, যিনি বহু বছর ধরে জাপানে নির্বাসিত জীবন কাটাচ্ছিলেন) “ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স লীগ” (Indian Independence League) এবং “আজাদ হিন্দ ফৌজ” (Indian National Army – INA) গঠন করেছিলেন। কিন্তু রাসবিহারী বসুর বার্ধক্য এবং সাংগঠনিক কিছু দুর্বলতার কারণে এই আন্দোলন তেমন গতি পাচ্ছিল না। সুভাষচন্দ্রের আগমনে সেই আন্দোলনে নতুন প্রাণের সঞ্চার হল।

১৯৪৩ সালের জুলাই মাসে সিঙ্গাপুরে অনুষ্ঠিত এক বিশাল জনসভায় রাসবিহারী বসু ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স লীগের সভাপতিত্ব এবং আজাদ হিন্দ ফৌজের নেতৃত্বভার সুভাষচন্দ্রের হাতে তুলে দেন। সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তে সুভাষচন্দ্র বসুকে “নেতাজি” উপাধিতে ভূষিত করা হয়। এই উপাধি তাঁর নামের সঙ্গে চিরদিনের জন্য জুড়ে যায়।

নেতাজি ফৌজের দায়িত্ব গ্রহণ করে এক তেজোদীপ্ত ভাষণে বলেন,

” তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব” (“Give me blood, and I shall give you freedom!”)।

তাঁর এই আহ্বান প্রবাসী ভারতীয় এবং যুদ্ধবন্দীদের শিরায় শিরায় আগুন ধরিয়ে দেয়। হাজার হাজার তরুণ-তরুণী, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে আজাদ হিন্দ ফৌজে যোগ দেওয়ার জন্য এগিয়ে আসেন।

নেতাজি অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে আজাদ হিন্দ ফৌজকে পুনর্গঠিত করেন। তিনি ফৌজে নতুন ব্রিগেড তৈরি করেন, যেমন – গান্ধী ব্রিগেড, নেহরু ব্রিগেড, আজাদ ব্রিগেড। শুধু তাই নয়, তিনি নারীদের নিয়েও একটি পৃথক বাহিনী গঠন করেন – “রানি ঝাঁসি রেজিমেন্ট”, যার নেতৃত্ব দেন ক্যাপ্টেন লক্ষ্মী স্বামীনাথন (পরে লক্ষ্মী সায়গল)। ইতিহাসে এটিই ছিল এশিয়ার প্রথম মহিলা সেনাবাহিনী। নেতাজি বিশ্বাস করতেন, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে নারীদেরও সমান ভূমিকা রয়েছে।

আজাদ হিন্দ ফৌজের সৈন্যদের মনোবল ছিল আকাশছোঁয়া। তাঁদের মুখে ছিল একটাই স্লোগান – “চলো দিল্লি”। তাঁদের হৃদয়ে ছিল একটাই স্বপ্ন – ব্রিটিশদের কবল থেকে মাতৃভূমিকে মুক্ত করে দিল্লির লালকেল্লায় ভারতের তেরঙা পতাকা ওড়ানো।

নেতাজির ক্যারিশম্যাটিক নেতৃত্ব, তাঁর অসামান্য সাংগঠনিক ক্ষমতা এবং তাঁর গভীর দেশপ্রেম আজাদ হিন্দ ফৌজকে এক অপরাজেয় শক্তিতে পরিণত করেছিল। তিনি সৈন্যদের শিখিয়েছিলেন শৃঙ্খলা, আত্মত্যাগ এবং দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করার মন্ত্র। জাপানের সামরিক সাহায্য থাকলেও, নেতাজি চেয়েছিলেন আজাদ হিন্দ ফৌজ যেন একটি সম্পূর্ণ স্বাধীন ভারতীয় বাহিনী হিসেবে পরিচিত হয়, জাপানের হাতের পুতুল হিসেবে নয়। এই লক্ষ্যেই তিনি পরবর্তী পদক্ষেপের জন্য প্রস্তুত হতে থাকেন।

আজাদ হিন্দ সরকার গঠনের পর নেতাজি জাপানের দখলে থাকা আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ পরিদর্শনে যান। জাপান সরকার এই দ্বীপপুঞ্জ দুটি আজাদ হিন্দ সরকারের হাতে তুলে দেয়। নেতাজি এই দ্বীপপুঞ্জ দুটির নতুন নামকরণ করেন “শহীদ” (আন্দামান) ও “স্বরাজ” (নিকোবর) দ্বীপ। তিনিই প্রথম ভারতীয় রাষ্ট্রপ্রধান যিনি ব্রিটিশ ভারতের এই অংশে স্বাধীন ভারতের পতাকা উত্তোলন করেছিলেন (৩০শে ডিসেম্বর, ১৯৪৩)। যদিও প্রশাসনিক ক্ষমতা পুরোপুরি আজাদ হিন্দ সরকারের হাতে আসেনি, তবুও এই ঘটনা ছিল প্রতীকীভাবে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।

আজাদ হিন্দ ফৌজের মূল সামরিক অভিযান শুরু হয় ১৯৪৪ সালের প্রথম দিকে। জাপানি সেনাবাহিনীর সহায়তায় আজাদ হিন্দ ফৌজ বার্মা (বর্তমান মায়ানমার) সীমান্ত পেরিয়ে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে প্রবেশ করে। তাদের লক্ষ্য ছিল ইম্ফল ও কোহিমা দখল করে ভারতের মূল ভূখণ্ডে প্রবেশ করা।

ফৌজের সৈন্যরা অসীম বীরত্ব ও আত্মত্যাগের সঙ্গে যুদ্ধ করতে থাকে। প্রতিকূল আবহাওয়া, খাদ্যাভাব, অপ্রতুল রসদ এবং ম্যালেরিয়া ও অন্যান্য রোগের প্রকোপ সত্ত্বেও তাঁরা ব্রিটিশ ও তাদের সহযোগী বাহিনীর বিরুদ্ধে একের পর এক সাহসিকতাপূর্ণ লড়াইয়ে অবতীর্ণ হন।

ইম্ফল ও কোহিমার যুদ্ধ ছিল অত্যন্ত রক্তক্ষয়ী। আজাদ হিন্দ ফৌজের সৈন্যরা বিভিন্ন স্থানে ব্রিটিশ বাহিনীকে পর্যুদস্ত করে কিছু সময়ের জন্য মৈরাং-এর মতো কয়েকটি ছোট শহর দখল করতেও সক্ষম হয়। মৈরাং-এ প্রথম স্বাধীন ভারতের পতাকা উত্তোলন করা হয় (১৪ই এপ্রিল, ১৯৪৪)। এই প্রাথমিক সাফল্যগুলি ভারতীয় জনগণের মধ্যে বিপুল আশার সঞ্চার করে। মনে হচ্ছিল, নেতাজির নেতৃত্বে ভারতের স্বাধীনতা বুঝি দোরগোড়ায়।

কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই যুদ্ধের গতি পরিবর্তিত হতে শুরু করে। বর্ষা এসে যাওয়ায় এবং জাপানি বিমানবাহিনীর সাহায্য কমে যাওয়ায় আজাদ হিন্দ ফৌজের অগ্রযাত্রা ব্যাহত হয়। অন্যদিকে, ব্রিটিশরা বিপুল সংখ্যক সৈন্য ও অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র নিয়ে প্রতি-আক্রমণ শুরু করে।

নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর জীবনী
নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর জীবনী

খাদ্যাভাব, রোগ এবং রসদের অভাবে আজাদ হিন্দ ফৌজের বহু সৈন্য বীরগতি প্রাপ্ত হন অথবা অসুস্থ হয়ে পড়েন। এই প্রতিকূল পরিস্থিতিতে নেতাজি তাঁর সৈন্যদের মনোবল অটুট রাখার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেন। তিনি নিজে রণাঙ্গনের কাছাকাছি উপস্থিত থেকে সৈন্যদের উৎসাহিত করতেন।

কয়েকটি কারণে তাদের অভিযান সফল হতে পারেনি:

  1. আবহাওয়ার প্রভাব: বর্ষাকালে সুভাষচন্দ্রের বাহিনী এগোতে পারেনি।
  2. জাপানের অস্বীকৃতি: জাপান তখন যুদ্ধের এক সংকটময় মুহূর্তে ছিল এবং তারা ভারতীয় বাহিনীর সাহায্য যথেষ্ট প্রদান করতে পারেনি।
  3. শক্তি সংকট: সাপ্লাই চেইনের সমস্যা, অস্ত্রের অভাব, এবং প্রয়োজনীয় রসদ যোগানের অক্ষমতা INA-এর জন্য বিশাল সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্রকৃতির বৈরিতা, রসদের অভাব এবং জাপানিদের পিছু হটার কারণে ইম্ফল ও কোহিমা অভিযান ব্যর্থ হয়। আজাদ হিন্দ ফৌজকে বাধ্য হয়ে পিছু হটতে হয়। এই পশ্চাদপসরণ ছিল অত্যন্ত বেদনাদায়ক। বহু সৈন্য পথেই মারা যান। তবুও, নেতাজি এবং তাঁর অনুগত সেনানীরা মনোবল হারাননি। তাঁরা বিশ্বাস করতেন, এই পরাজয় সাময়িক। তাঁরা পুনরায় শক্তি সঞ্চয় করে নতুন উদ্যমে লড়াই শুরু করার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন।

১৯৪৫ সাল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের গতিপ্রকৃতি তখন সম্পূর্ণভাবে মিত্রশক্তির অনুকূলে। জার্মানির পতন ঘটেছে, ইতালি আগেই আত্মসমর্পণ করেছে। প্রাচ্যে জাপান একাই লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু তাদের পরাজয়ও তখন সময়ের অপেক্ষা।

এই প্রতিকূল পরিস্থিতিতে আজাদ হিন্দ ফৌজ এবং অস্থায়ী আজাদ হিন্দ সরকারের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। জাপানিরা ক্রমশ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে পিছু হটতে শুরু করে। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু তখন তাঁর অনুগত সেনানীদের নিয়ে বার্মা থেকে থাইল্যান্ড হয়ে সিঙ্গাপুরের দিকে পশ্চাদপসরণ করছিলেন।

আগস্ট মাসের শুরুতে হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পরমাণু বোমা নিক্ষেপের পর জাপান চূড়ান্তভাবে আত্মসমর্পণ করে। এই ঘটনা নেতাজির পরিকল্পনায় এক বিরাট আঘাত হানে। তিনি বুঝতে পারছিলেন যে, জাপানের উপর নির্ভর করে আর যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। তখন তাঁর মাথায় একটাই চিন্তা – কীভাবে তাঁর বিশ্বস্ত সহকর্মী এবং আজাদ হিন্দ ফৌজের সেনানীদের নিরাপদে সরিয়ে আনা যায় এবং ভবিষ্যৎ সংগ্রামের জন্য নতুন কোনো পথ খুঁজে বের করা যায়।

শোনা যায়, এই সময়ে তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের সাহায্য নিয়ে নতুন করে লড়াই শুরু করার কথা ভাবছিলেন।

এই উদ্দেশ্যেই, ১৯৪৫ সালের ১৮ই আগস্ট, নেতাজি একটি জাপানি বোমারু বিমানে করে ব্যাংকক থেকে সাইগন (বর্তমান হো চি মিন সিটি) হয়ে মাঞ্চুরিয়ার দাইরেন শহরের দিকে যাত্রা করেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন তাঁর বিশ্বস্ত সহযোগী হাবিবুর রহমান। কিন্তু পথিমধ্যে, তাইওয়ানের তাইহোকু (বর্তমান তাইপে) বিমানবন্দরের কাছে বিমানটি দুর্ঘটনার কবলে পড়ে এবং আগুন ধরে যায় বলে জাপানি সূত্রে ঘোষণা করা হয়।

এই সূত্র অনুযায়ী, গুরুতরভাবে দগ্ধ অবস্থায় নেতাজিকে তাইহোকুর একটি মিলিটারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয় এবং সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়। আরও জানানো হয় যে, তাইহোকুতেই তাঁর মরদেহ দাহ করা হয় এবং তাঁর চিতাভস্ম টোকিওর রেনকোজি মন্দিরে সংরক্ষণ করা হয়।

এই খবর প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সারা ভারতে এবং বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে প্রবাসী ভারতীয়দের মধ্যে শোকের ছায়া নেমে আসে। কিন্তু অনেকেই এই আকস্মিক মৃত্যুর খবর বিশ্বাস করতে পারেননি। তাঁদের মনে হয়েছিল, এর পিছনে নিশ্চয়ই কোনও গভীর রহস্য লুকিয়ে আছে। নেতাজির মতো একজন অসামান্য ব্যক্তিত্ব, যিনি বারবার ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের চোখে ধুলো দিয়ে পালিয়েছেন, তিনি এত সহজে মৃত্যুবরণ করতে পারেন না – এই বিশ্বাস অনেকের মনেই দৃঢ় ছিল।

এরপর থেকেই শুরু হয় নেতাজির অন্তর্ধান রহস্য নিয়ে নানা জল্পনা-কল্পনা, বিতর্ক এবং তদন্ত। ভারত সরকার এই রহস্য উদঘাটনের জন্য বিভিন্ন সময়ে তিনটি তদন্ত কমিশন গঠন করে

নেতাজির অন্তর্ধান রহস্য নিয়ে আজও নানা তত্ত্ব প্রচলিত আছে। কেউ বলেন, তিনি বিমান দুর্ঘটনার পর বেঁচে গিয়েছিলেন এবং আত্মগোপন করে ছিলেন। কেউ বিশ্বাস করেন, তিনি সোভিয়েত রাশিয়ায় চলে গিয়েছিলেন এবং সেখানেই বন্দি অবস্থায় মারা যান অথবা নতুন নামে বসবাস করছিলেন।

অনেকে আবার মনে করেন, তিনি সাধু বা সন্ন্যাসীর ছদ্মবেশে ভারতেই ফিরে এসেছিলেন এবং গুমনামি বাবা বা ভগবানজী নামে পরিচিত হয়েছিলেন। এই প্রতিটি তত্ত্বেরই কিছু সমর্থক এবং কিছু প্রমাণ (বা তথাকথিত প্রমাণ) রয়েছে, কিন্তু কোনওটিই অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয়নি।

নেতাজির অন্তর্ধান এক অসমাপ্ত অধ্যায় হিসেবেই রয়ে গেছে। তাঁর অনুগামী এবং বহু ভারতবাসীর হৃদয়ে আজও এই আশা বেঁচে আছে যে, হয়তো একদিন এই রহস্যের কিনারা হবে, হয়তো নেতাজি অন্য কোনও রূপে ফিরে আসবেন।

netaji subhash chandra bose story in bengali
netaji subhash chandra bose story in bengali

তিনি যেন এক ধ্রুবতারা, যাঁর অনুপস্থিতি সত্ত্বেও তাঁর আলোকরশ্মি ভারতের আকাশকে আজও আলোকিত করে রেখেছে।

“নেতাজি কি ফিরে আসবেন?” – এই প্রশ্ন আজও লক্ষ লক্ষ মানুষের মনে অনুরণিত হয়, যা তাঁর প্রতি গভীর ভালোবাসা ও শ্রদ্ধারই প্রতিফলন। তাঁর শেষ পরিণতি যাই হোক না কেন, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে তাঁর অবদান এবং তাঁর আদর্শ চিরভাস্বর হয়ে থাকবে।

Disclaimer:
All images used in this blog post are AI-generated and purely imaginative. They are not real photographs and have no direct connection to actual events or historical moments. Used for visual representation only.

কি হয়েছিল সেই রহস্যময় দিনটিতে যেদিন থেকে নেতাজী হারিয়ে গেলেন! পড়তে এখানে ক্লিক করুন

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে যুক্ত কিছু অজানা তথ্য (পৃথিবীর কোন স্কুল পড়াবে না)



Discover more from IntellectPedia

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

Leave a Reply

Scroll to Top